স্টুডেন্ট ভিসা (Student Visa) হলো একটি বিশেষ ধরনের ভিসা, যা বিদেশি শিক্ষার্থীদের অন্য দেশে গিয়ে শিক্ষা গ্রহণের অনুমতি দেয়। এটি সাধারণত অস্থায়ী হয় এবং শিক্ষার মেয়াদের উপর নির্ভর করে এর সময়কাল নির্ধারিত হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উচ্চশিক্ষা, গবেষণা এবং পেশাগত দক্ষতা অর্জনের জন্য শিক্ষার্থীরা এই ভিসার জন্য আবেদন করে।
বর্তমান সময়ে গ্লোবালাইজেশনের ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আন্তর্জাতিক শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বেড়েছে, যা তাদের ক্যারিয়ার গঠন, জ্ঞান অর্জন এবং বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ করে দেয়। তবে, এই ভিসা পাওয়ার জন্য কিছু নির্দিষ্ট যোগ্যতা এবং শর্ত পূরণ করতে হয়, যা দেশভেদে ভিন্ন হতে পারে।
স্টুডেন্ট ভিসার গুরুত্ব অনেক। এটি শুধু শিক্ষার জন্যই নয়, বরং ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ারের জন্যও একটি ভিত্তি তৈরি করে। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যের মতো দেশে পড়াশোনা করলে শিক্ষার্থীরা বিশ্বমানের শিক্ষা, গবেষণার সুযোগ এবং আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কিংয়ের সুবিধা পায়।
স্টুডেন্ট ভিসার (Student Visa) জন্য সাধারণ যোগ্যতা
স্টুডেন্ট ভিসার জন্য কিছু মৌলিক শর্ত সব দেশে প্রায় একই রকম। এগুলো হলো:
১. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি
স্টুডেন্ট ভিসা পাওয়ার প্রথম ধাপ হলো কোনো স্বীকৃত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়া। এটি হতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, ট্রেনিং ইনস্টিটিউট বা ভাষা শিক্ষার স্কুল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি অবশ্যই সেই দেশের সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক স্বীকৃত হতে হবে। ভর্তির পর আপনি একটি অফিসিয়াল অফার লেটার বা অ্যাকসেপ্টেন্স লেটার পাবেন, যা ভিসা আবেদনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- যুক্তরাষ্ট্রে: SEVP (Student and Exchange Visitor Program) স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান থেকে I-20 ফর্ম দেওয়া হয়।
- যুক্তরাজ্যে: আপনার একটি CAS (Confirmation of Acceptance for Studies) নম্বর লাগবে।
- কানাডায়: LOA (Letter of Acceptance) প্রয়োজন।
- অস্ট্রেলিয়ায়: CoE (Confirmation of Enrolment) পেতে হবে।
২. আর্থিক সক্ষমতা
ভিসা কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করতে চায় যে আপনি বিদেশে থাকাকালীন নিজের খরচ বহন করতে পারবেন। এর মধ্যে টিউশন ফি, থাকা-খাওয়া, ভ্রমণ এবং অন্যান্য খরচ অন্তর্ভুক্ত। এটি প্রমাণ করতে আপনাকে ব্যাংক স্টেটমেন্ট, স্পনসরশিপ লেটার বা স্কলারশিপের ডকুমেন্ট জমা দিতে হবে।
- যুক্তরাষ্ট্রে: প্রতি বছর ২৫,০০০ থেকে ৪০,০০০ ডলারের প্রমাণ লাগতে পারে, প্রতিষ্ঠান ও শহরের উপর নির্ভর করে।
- যুক্তরাজ্যে: লন্ডনে পড়তে হলে প্রথম বছরের জন্য ১২,০০০ পাউন্ড এবং লন্ডনের বাইরে ৯,০০০ পাউন্ড।
- কানাডায়: টিউশন ফি ছাড়াও ১০,০০০ CAD জীবনযাত্রার জন্য।
- অস্ট্রেলিয়ায়: বার্ষিক ২১,০৪১ AUD জীবনযাত্রার খরচ দেখাতে হয়।
৩. ভাষাগত দক্ষতা
বেশিরভাগ দেশে পড়াশোনার জন্য ইংরেজি বা স্থানীয় ভাষায় দক্ষতা প্রমাণ করতে হয়। এটি বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই করা হয়।
- ইংরেজি: IELTS, TOEFL, PTE Academic সবচেয়ে জনপ্রিয়। উদাহরণস্বরূপ, IELTS-এ সাধারণত ৬.০ থেকে ৭.০ স্কোর চাওয়া হয়। TOEFL-এ ৮০-১০০ স্কোর।
- অন্যান্য ভাষা: ফ্রান্সের জন্য DELF/DALF, জার্মানির জন্য TestDaF বা Goethe-Zertifikat।
৪. বৈধ পাসপোর্ট
আপনার পাসপোর্ট অবশ্যই বৈধ হতে হবে এবং এর মেয়াদ সাধারণত আপনার পড়াশোনার সময়কালের চেয়ে কমপক্ষে ৬ মাস বেশি থাকতে হবে। পাসপোর্টের ফটোকপি এবং পুরোনো ভিসার রেকর্ড (যদি থাকে) জমা দিতে হতে পারে।
৫. স্বাস্থ্য ও চরিত্রের প্রমাণ
- স্বাস্থ্য: অনেক দেশে মেডিকেল চেকআপ বাধ্যতামূলক। যেমন, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডায় TB টেস্ট বা সম্পূর্ণ স্বাস্থ্য পরীক্ষা।
- চরিত্র: পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট দিয়ে দেখাতে হবে যে আপনার কোনো ফৌজদারি রেকর্ড নেই।
৬. শিক্ষাগত যোগ্যতা
আপনার পূর্ববর্তী শিক্ষার প্রমাণ দিতে হবে। যেমন:
- স্নাতকের জন্য এইচএসসি বা সমমান।
- স্নাতকোত্তরের জন্য স্নাতক ডিগ্রি।
- ট্রান্সক্রিপ্ট এবং সার্টিফিকেটের সত্যায়িত কপি জমা দিতে হয়।
৭. উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনা
ভিসা অফিসাররা জানতে চায় আপনার পড়াশোনার উদ্দেশ্য কী এবং এর পর আপনি কী করবেন। যেমন, যুক্তরাষ্ট্রে F-1 ভিসার জন্য প্রমাণ করতে হয় যে পড়াশোনা শেষে আপনি দেশে ফিরবেন।
দেখুনঃ আমেরিকার স্টুডেন্ট ভিসা (F1) ইন্টারভিউ গোপন রহস্য
Credit: LoJaiga
দেশভিত্তিক স্টুডেন্ট ভিসার যোগ্যতা
স্টুডেন্ট ভিসার যোগ্যতা দেশভেদে ভিন্ন হয়, কারণ প্রতিটি দেশের নিজস্ব শিক্ষা ও ইমিগ্রেশন নীতি রয়েছে।
১. যুক্তরাষ্ট্র (F-1 ভিসা)
যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় শিক্ষার গন্তব্য। এখানে পড়তে F-1 ভিসা প্রয়োজন। যোগ্যতা:
- ভর্তি: SEVP (Student and Exchange Visitor Program) স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান থেকে I-20 ফর্ম পেতে হবে। এটি ভর্তির পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জারি করে।
- আর্থিক সক্ষমতা: টিউশন ফি এবং জীবনযাত্রার খরচের জন্য পর্যাপ্ত তহবিল দেখাতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, একটি গড় বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরে ২৫,০০০-৪০,০০০ ডলার লাগতে পারে। ব্যাংক স্টেটমেন্ট বা স্পনসরের চিঠি জমা দিতে হয়।
- ভাষা দক্ষতা: TOEFL (৮০+) বা IELTS (৬.৫+) স্কোর প্রয়োজন। কিছু প্রতিষ্ঠানে এর চেয়ে বেশি স্কোর চাইতে পারে।
- ইন্টারভিউ: মার্কিন দূতাবাসে ইন্টারভিউয়ে অংশ নিতে হয়। এখানে আপনার পড়াশোনার উদ্দেশ্য এবং দেশে ফেরার পরিকল্পনা ব্যাখ্যা করতে হবে।
- SEVIS ফি: ভিসা আবেদনের আগে ৩৫০ ডলার SEVIS (Student and Exchange Visitor Information System) ফি দিতে হয়।
- ভিসা ফি: ১৮৫ ডলার।
২. যুক্তরাজ্য (Student Visa, পূর্বে Tier 4)
যুক্তরাজ্যে উচ্চশিক্ষার জন্য Student Visa প্রয়োজন। যোগ্যতা:
- CAS: Confirmation of Acceptance for Studies নম্বর, যা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দেয়।
- আর্থিক প্রমাণ: লন্ডনে পড়তে হলে প্রথম বছরের জন্য ১২,০০০ পাউন্ড এবং লন্ডনের বাইরে ৯,০০০ পাউন্ড। টিউশন ফি আলাদাভাবে দেখাতে হয়।
- ভাষা: IELTS-এ ন্যূনতম ৫.৫ স্কোর (B2 লেভেল)। স্নাতকোত্তরের জন্য ৬.৫ বা তার বেশি চাইতে পারে।
- TB টেস্ট: বাংলাদেশ থেকে আবেদন করলে টিউবারকুলোসিস টেস্ট বাধ্যতামূলক।
- ভিসা ফি: ৩৪৮ পাউন্ড। এছাড়া NHS সারচার্জ হিসেবে বছরে ৬২৪ পাউন্ড দিতে হয়।
৩. কানাডা (Study Permit)
কানাডার শিক্ষাব্যবস্থা এবং অভিবাসন সুযোগের জন্য জনপ্রিয়। Study Permit-এর যোগ্যতা:
- LOA: Letter of Acceptance স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান থেকে।
- আর্থিক: প্রথম বছরের টিউশন ফি + ১০,০০০ CAD জীবনযাত্রার জন্য। ব্যাংক স্টেটমেন্ট ৪-৬ মাসের হতে হবে।
- ভাষা: IELTS-এ ৬.০ বা TOEFL-এ ৮০।
- GIC: SDS (Student Direct Stream) প্রোগ্রামে আবেদন করলে ১০,০০০ CAD-এর Guaranteed Investment Certificate কিনতে হয়।
- মেডিকেল টেস্ট: কিছু ক্ষেত্রে প্রয়োজন।
- ভিসা ফি: ১৫০ CAD।
৪. অস্ট্রেলিয়া (Subclass 500)
অস্ট্রেলিয়া তার গুণগত শিক্ষা ও জীবনযাত্রার জন্য আকর্ষণীয়। Subclass 500 ভিসার যোগ্যতা:
- CoE: Confirmation of Enrolment শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে।
- আর্থিক: বছরে ২১,০৪১ AUD জীবনযাত্রার জন্য এবং টিউশন ফি আলাদা।
- ভাষা: IELTS-এ ৫.৫-৬.৫ (কোর্সের উপর নির্ভর করে)।
- OSHC: Overseas Student Health Cover বাধ্যতামূলক। এটি স্বাস্থ্য বীমা হিসেবে কাজ করে।
- GTE: Genuine Temporary Entrant স্টেটমেন্ট লিখতে হয়, যেখানে পড়াশোনার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করতে হয়।
- ভিসা ফি: ৬২০ AUD।
৫. জার্মানি (Student Visa)
জার্মানি তার বিনামূল্যে বা কম খরচের শিক্ষার জন্য বিখ্যাত। যোগ্যতা:
- ভর্তি: বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অ্যাডমিশন লেটার।
- আর্থিক: বছরে ১১,২০৮ ইউরোর ব্লকড অ্যাকাউন্ট (Blocked Account) খুলতে হয়। এটি থেকে প্রতি মাসে ৯৩৪ ইউরো তুলতে পারবেন।
- ভাষা: জার্মান কোর্সের জন্য B2 বা C1 লেভেল (TestDaF/Goethe-Zertifikat); ইংরেজি কোর্সের জন্য IELTS ৬.৫।
- স্বাস্থ্য বীমা: জার্মান স্বাস্থ্য বীমা বাধ্যতামূলক।
- ভিসা ফি: ৭৫ ইউরো।
৬. ফ্রান্স (VLS-TS Étudiant)
ফ্রান্সে শিল্প, সংস্কৃতি এবং শিক্ষার সমন্বয় আকর্ষণীয়। যোগ্যতা:
- ভর্তি: ফরাসি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে অ্যাকসেপ্টেন্স লেটার।
- আর্থিক: বছরে ন্যূনতম ৭,৩৮০ ইউরো (মাসে ৬১৫ ইউরো)।
- ভাষা: ফরাসি কোর্সের জন্য DELF/DALF B2 লেভেল; ইংরেজি কোর্সের জন্য IELTS ৬.০।
- Campus France: আবেদনের আগে Campus France-এর মাধ্যমে ইন্টারভিউ দিতে হয়।
- ভিসা ফি: ৯৯ ইউরো।
- মেডিকেল টেস্ট: কিছু ক্ষেত্রে প্রয়োজন।
৭. নেদারল্যান্ডস (Residence Permit for Study)
নেদারল্যান্ডসে ইংরেজি মাধ্যমে অনেক কোর্স রয়েছে। যোগ্যতা:
- ভর্তি: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে অ্যাডমিশন লেটার। প্রতিষ্ঠানটি Nuffic-এ নিবন্ধিত হতে হবে।
- আর্থিক: বছরে ১১,৫২০ ইউরো।
- ভাষা: IELTS ৬.০ বা TOEFL ৮০।
- স্বাস্থ্য বীমা: বাধ্যতামূলক।
- MVV: প্রাথমিক এন্ট্রি ভিসা (১৭৪ ইউরো) এবং রেসিডেন্স পারমিট ফি (২০৭ ইউরো)।
৮. নিউজিল্যান্ড (Student Visa)
নিউজিল্যান্ড তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও শিক্ষার জন্য পরিচিত। যোগ্যতা:
- ভর্তি: Offer of Place শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে।
- আর্থিক: বছরে ১৫,০০০ NZD জীবনযাত্রার জন্য।
- ভাষা: IELTS ৫.৫-৬.৫।
- স্বাস্থ্য ও চরিত্র: মেডিকেল টেস্ট এবং পুলিশ ক্লিয়ারেন্স।
- ভিসা ফি: ৩৩০ NZD।
৯. সুইডেন (Residence Permit for Studies)
সুইডেনে গবেষণা ও উদ্ভাবনের জন্য সুযোগ রয়েছে। যোগ্যতা:
- ভর্তি: বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অ্যাডমিশন লেটার।
- আর্থিক: বছরে ১০১,৬৮০ SEK (মাসে ৮,৪৭০ SEK)।
- ভাষা: IELTS ৬.৫।
- বীমা: স্বাস্থ্য ও দুর্ঘটনা বীমা।
- ভিসা ফি: ১,৫০০ SEK।
১০. জাপান (Student Visa)
জাপান প্রযুক্তি ও সংস্কৃতির জন্য আকর্ষণীয়। যোগ্যতা:
- ভর্তি: Certificate of Eligibility (CoE) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে।
- আর্থিক: বছরে ২০ লাখ ইয়েন (প্রায় ১৮,০০০ USD)।
- ভাষা: জাপানি কোর্সের জন্য JLPT N5-N2; ইংরেজি কোর্সের জন্য IELTS ৬.০।
- ভিসা ফি: ৩,০০০ ইয়েন।
আবেদন প্রক্রিয়া
১. প্রতিষ্ঠান নির্বাচন ও ভর্তি: আপনার পছন্দের কোর্স ও প্রতিষ্ঠানে আবেদন করুন। ভর্তি হওয়ার পর অফার লেটার নিন।
২. নথি সংগ্রহ: পাসপোর্ট, শিক্ষাগত সার্টিফিকেট, ভাষা স্কোর, আর্থিক প্রমাণ, মেডিকেল রিপোর্ট ইত্যাদি।
৩. অনলাইন আবেদন: সংশ্লিষ্ট দেশের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে ফর্ম পূরণ করুন।
৪. ফি জমা: ভিসা ফি পরিশোধ করুন।
৫. বায়োমেট্রিক ও ইন্টারভিউ: বায়োমেট্রিক দিন এবং প্রয়োজনে ইন্টারভিউয়ে অংশ নিন।
৬. অপেক্ষা: ভিসার ফলাফলের জন্য ২-১২ সপ্তাহ অপেক্ষা করুন।
চ্যালেঞ্জ ও সমাধান
- আর্থিক সমস্যা: স্কলারশিপ (যেমন Fulbright, Chevening) বা শিক্ষা ঋণ।
- ভাষার দুর্বলতা: কোচিং বা অনলাইন কোর্স।
- ভিসা প্রত্যাখ্যান: সঠিক ডকুমেন্ট ও পরিষ্কার উদ্দেশ্য উপস্থাপন।
বিস্তারিত তথ্য ও তুলনা
প্রতিটি দেশের ভিসা শর্তে কিছু মিল ও পার্থক্য রয়েছে। যেমন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে ইন্টারভিউ বাধ্যতামূলক, কিন্তু জার্মানি বা সুইডেনে সাধারণত নয়। আর্থিক প্রমাণ সব দেশেই চাওয়া হয়, তবে পরিমাণ ভিন্ন। ভাষার ক্ষেত্রে ইংরেজি মাধ্যমের দেশে IELTS/TOEFL প্রধান, আর ফ্রান্স বা জাপানে স্থানীয় ভাষার দক্ষতা গুরুত্বপূর্ণ।
স্টুডেন্ট ভিসার সাধারণ শর্ত
বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের জন্য স্টুডেন্ট ভিসার মৌলিক শর্তগুলো অন্যান্য দেশের শিক্ষার্থীদের মতোই। তবে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটের কারণে কিছু বিষয়ে অতিরিক্ত প্রমাণ দিতে হয়। প্রধান শর্তগুলো হলো:
১. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি: বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের প্রথমে একটি স্বীকৃত বিদেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে হবে। ভর্তির প্রমাণ হিসেবে অফার লেটার বা অ্যাকসেপ্টেন্স লেটার প্রয়োজন। যেমন, যুক্তরাষ্ট্রে I-20, যুক্তরাজ্যে CAS, কানাডায় LOA, অস্ট্রেলিয়ায় CoE ইত্যাদি।
২. আর্থিক সক্ষমতা: বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের জন্য এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ভিসা কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করতে চায় যে আপনি টিউশন ফি, জীবনযাত্রার খরচ এবং অন্যান্য খরচ বহন করতে পারবেন। উদাহরণস্বরূপ:
- যুক্তরাষ্ট্রে বছরে ২৫,০০০-৪০,০০০ USD।
- কানাডায় টিউশন ফি + ১০,০০০ CAD।
- অস্ট্রেলিয়ায় ২১,০৪১ AUD।
- বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের এই অর্থ ব্যাংক স্টেটমেন্ট, স্পনসরশিপ (যেমন বাবা-মা বা আত্মীয়) বা স্কলারশিপের মাধ্যমে দেখাতে হয়।
৩. ভাষাগত দক্ষতা: বেশিরভাগ দেশে ইংরেজি ভাষায় দক্ষতার প্রমাণ দিতে হয়। বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের জন্য IELTS বা TOEFL সবচেয়ে জনপ্রিয়। সাধারণত IELTS-এ ৬.০-৭.০ বা TOEFL-এ ৮০-১০০ স্কোর চাওয়া হয়। জার্মানি বা ফ্রান্সে পড়তে হলে জার্মান (TestDaF) বা ফরাসি (DELF) ভাষার দক্ষতা লাগে।
৪. শিক্ষাগত যোগ্যতা: এইচএসসি বা সমমানের সার্টিফিকেট স্নাতকের জন্য, এবং স্নাতক ডিগ্রি স্নাতকোত্তরের জন্য প্রয়োজন। বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের সাধারণত ভালো ফলাফল (CGPA ৩.০+) দেখাতে হয়।
৫. স্বাস্থ্য ও চরিত্র: মেডিকেল টেস্ট (যেমন TB টেস্ট) এবং পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট বাধ্যতামূলক। বাংলাদেশে এই সার্টিফিকেট স্থানীয় থানা বা স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে সংগ্রহ করা যায়।
৬. বৈধ পাসপোর্ট: পাসপোর্টের মেয়াদ কমপক্ষে ৬ মাস থাকতে হবে।
আরও পড়ুনঃ পৃথিবীর সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা
জনপ্রিয় দেশ ও বাংলাদেশীদের জন্য নির্দিষ্ট শর্ত
যুক্তরাষ্ট্র (F-1 ভিসা)
বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে ভিসা পাওয়া কঠিন হতে পারে, কারণ ইন্টারভিউয়ে দেশে ফেরার ইচ্ছা প্রমাণ করতে হয়। আর্থিক প্রমাণ হিসেবে ২৫,০০০-৪০,০০০ USD দেখাতে হয়। ভিসা ফি ১৮৫ USD এবং SEVIS ফি ৩৫০ USD।
যুক্তরাজ্য (Student Visa)
যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশীদের জন্য TB টেস্ট বাধ্যতামূলক। আর্থিক প্রমাণ হিসেবে লন্ডনে ১২,০০০ পাউন্ড এবং অন্যত্র ৯,০০০ পাউন্ড লাগে। IELTS-এ ৫.৫+ স্কোর প্রয়োজন। ভিসা ফি ৩৪৮ পাউন্ড।
কানাডা (Study Permit)
কানাডা বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের জন্য জনপ্রিয়, কারণ এখানে পড়াশোনার পর PR (Permanent Residency) পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। SDS প্রোগ্রামে আবেদন করলে ১০,০০০ CAD-এর GIC এবং IELTS ৬.০ লাগে। ভিসা ফি ১৫০ CAD।
অস্ট্রেলিয়া (Subclass 500)
অস্ট্রেলিয়ায় ২১,০৪১ AUD জীবনযাত্রার জন্য এবং OSHC (স্বাস্থ্য বীমা) কিনতে হয়। IELTS ৫.৫-৬.৫ স্কোর চাওয়া হয়। ভিসা ফি ৬২০ AUD।
জার্মানি (Student Visa)
জার্মানিতে পড়াশোনা প্রায় বিনামূল্যে, তবে ১১,২০৮ ইউরোর ব্লকড অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়। বাংলাদেশীদের জন্য জার্মান ভাষা (B2) শেখা একটি চ্যালেঞ্জ। ভিসা ফি ৭৫ ইউরো।
শেষ কথা
বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের জন্য বিদেশে পড়ার সুবিধা অনেক। যেমন, কানাডা বা অস্ট্রেলিয়ায় পড়াশোনার পর কাজের সুযোগ এবং PR পাওয়া যায়। জার্মানিতে কম খরচে পড়া সম্ভব। যুক্তরাষ্ট্রে গবেষণার সুযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের জন্য স্টুডেন্ট ভিসা পাওয়া চ্যালেঞ্জিং হলেও সঠিক পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির মাধ্যমে সম্ভব। আর্থিক সক্ষমতা, ভাষা দক্ষতা এবং সঠিক ডকুমেন্টেশন এখানে মূল ভূমিকা পালন করে। স্বপ্ন পূরণের জন্য ধৈর্য ও প্রচেষ্টা জরুরি।
[…] […]